বৃটিশ সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হলে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সমগ্র দেশকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এসময় অবিভক্ত এবং বৃহৎ বঙ্গভূমির নাম হয়েছিল প্রেসিডেন্সী বা বঙ্গভূমি প্রদেশ। আবার প্রান্তিক অবস্থাভেদে বঙ্গে উত্তর প্রান্তীয় ভূভাগকে বলা হয়েছে উত্তরবঙ্গ।
এই রাজশাহী বিভাগের মধ্য ইংরেজি পরীক্ষার প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে সাধারণ তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন শ্রী পঞ্চানন সরকার। ১৮৮৫-১৮৮৬ সালের কুচবিহার গেজেটে শিক্ষা-বিষয়ক রিপোর্টে কালিদাস বাবুর লেখা থেকে পাই- Panchanan Sir car a native of Coochbeher, who passed the M.E. Examination in the First Division from Mathabhanga School succeeded to secure the first place in the general list of the Rajshahi Division. বাবার মুক্তারী চেতনার প্রবাব এবং সমাজ-জীবনবোধ তাঁকে ছোটোবেলা থেকে আন্দোলিত করে তুলেছিল। বিদ্যা-বুদ্ধির প্রখরতা ও সমাজের গহন-গভীরের ব্যথা-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কালক্রমে তিনি হলেন কিংবদন্তী মানুষ শ্রীপঞ্চানন।
তাঁর জন্ম কুচবিহারের মাটিতে। গাছপালা, জল-হাওয়া, ধরলা ও দিলদরিয়া নদীর আহবে পুষ্ট হয়ে উঠেছেন। গৃহস্থ, সমর্থ-গৃহস্থ, জোতদার পরিবেষ্টিত দেশজ সংস্কৃতি ও হিন্দুর দশকর্মবিধির প্রবাহ তাঁর বাসভূমিতে। এরকম পরিবেশে একটি পরিচ্ছন্ন গ্রামে পূর্ব ভারতের বৃটিশ-মিত্র রাজ্য কুচবিহারে পঞ্চানন জন্ম নেন। এই পঞ্চানন সমাজে এখন মানুষের হৃদয়-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রাজাধিরাজ। জন্মের সময়টা ছিল ১৮৬৬ সাল। কুচবিহার জেলার মাথাভাঙ্গা মহকুমার খলিসামারি গ্রাম। কুচবিহারে তখন মহারাজা ছিলেন নরেন্দ্রনারায়ণ। মহারাজার পুত্র বৃটিশ-ভারতে খ্যাত মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ জন্ম নেন রায়সাহেব পঞ্চাননের জন্মের কিছু বছর আগে, ১৮৬৪ সালে। এগার মাস বয়স থেকে নৃপেন্দ্র নারায়ণ রাজা। সে-সময়ে রাজ্যের সিংহাসন নিয়ে যতীন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয়। কিন্তু কর্ণেল হটন সাহেবের মধ্যস্থতায় নৃপেন্দ্র নারায়ণই রাজা হন। মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যু হলে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল।
মানুষের হৃদয়ের রাজাধিরাজ পঞ্চাননের জন্মের সময় তাঁর পরিবারের প্রচলিত রীতিনীতি তৎকাল গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। সমসাময়িককালে নৃপেন্দ্র নারায়ণের জন্মের দেশীয় রীতি-নীতিকে ছাপিয়ে ব্রাক্ষণ্য সাংস্কৃতিক ধারাটি প্রবল ছিল। নৃপেন্দ্র নারায়ণের বড় হয়ে উঠার সমস্ত দায়িত্ব অর্পিত ছিল বঙ্গীয় কুলীণ নবকান্ত মজুমদার, দেওয়ান ব্রাক্ষণ নীলকমল সান্যাল, সীতেশ সান্যাল প্রমুখ বঙ্গীয় দেশীয় রাজকর্মচারীগণের। কুচবিহার রাজধানীর জৌলুষ থেকে বহু দূরে মাথাভাঙ্গার খলিসামারি গ্রামে আর একজন মহাপুরুষ গ্রামীণ পরিবেশে প্রবাহমান ভারতীয় ধারায় শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেছিলেন। উল্লেখ্য, ঠিক তাঁর কয়েক বছর আগে থেকে জোড়াসাঁকোতে বড় হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
স্বাধীন মতাদর্শ প্রকাশ, সামাজিক উন্নয়নের বিধান, জাতির মোচন, কৃষক ও দিনমজুর মানুষের উন্নতি সাধন, নারীদের মর্যদা রক্ষা, পুরাতন দৃষ্টির মূল্যায়ন- এই বিষয়গুলি রূপায়ণের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি রাজরোষমুক্ত অঞ্চল। বৃটিশ করদ মিত্র কুচবিহার রাজ্য ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন অবিভক্ত বঙ্গ দেশের রংপুর শহর। এই শহরই তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। বাঙ্গালি যে সমাজে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা ছিল রাজবংশীয় ক্ষত্রিয় সমাজ। সে সময়ে নিদ্রাচ্ছন্ন রাজবংশীয় সমাজকে ক্ষত্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলার সমস্তরকম বৈপ্লবিক কর্মসূচীর নেতৃত্ব ছিলেন তিনি। সেই আন্দোলনের ঢেউ নিজের গণ্ডী ছাড়িয়ে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে থেকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তা ছিল সমাজে স্বীকৃতির লড়াই। এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন তিনি।
বলাবাহুল্য, রংপুর শহর পঞ্চানন বর্মার মূল কর্মক্ষেত্র ছিল। আগে থেকেই এই শহরকে ঘিরে মহাজীবন ও কবি-সাহিত্যিকদের চিন্তার বলয় সৃষ্টি হয়েছিল। এই রংপুরেই ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ান ছিলেন রাজা রামমোহন রায়।
বাঙ্গলার মনীষীদের কথা উঠলেই রামমোহন, বিদ্যাসাগর, কেশব সেন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ- এইসকল মনীষীদের নাম উজ্জ্বল হয়ে উঠে। বাঙ্গালি সমাজ জীবনের ভৌগোলিক পরিধিটি অনেক বড়। এই ভৌগোলিক পরিধির সঙ্গে শুধু বল্লালী-ছত্রিশ জাতের ইতিহাসটাই সম্পূর্ণ নয়। বৃহৎ বঙ্গদেশে বিশেষ করে অবিভক্ত উত্তরবঙ্গের বাঙ্গালি সংস্কৃতিতে পুষ্টি নানা বর্ণের মানুষরাও আছেন। ব্রাক্ষ্ণণ্য শ্রেণিবিভাজনে বাঙ্গলায় ক্ষত্রিয় নেই বলে আমরা কি শ্লাঘা বোধ করি? বৃহৎ বঙ্গদেশের জাতি-সংস্কৃতির ইতিহাসে ক্ষত্রিয় জাতির একটি বিরাট গৌরব অধ্যায় রয়েছে। ইতিহাসের ঘটনা পরস্পরায় মহাপদ্মনন্দের সঙ্গে সংগ্রামে পরাস্ত হয়ে পুন্ড্রবর্ধন এলাকায় আর্য ক্ষত্রিয়রা আত্মগোপন করে থাকেন দীর্ঘকাল। স্থানীয় নানা অনার্য লোকের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটে।এই আত্মগোপনের পরিধির বিস্তৃত লাভ করে তৎকাল কামরূপের রত্নপীঠ এলাকায়। বর্তমান বৃহৎ জলপাইগুড়ি জেলার এলাকায় ছিল এই রত্নপীঠ। দীর্ঘকাল প্রায় ২৩০০ বছর একই ভূখন্ডে থাকার ফলে আত্মগোপনকারী আর্য ক্ষত্রিয়দের মধ্যে সামাজিক ও দৈহিক বৈশিষ্ট্যের কিছু পরিবর্তন ঘটে। অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় প্রেণিভুক্ত মানুষের সমুদ্র পথে সুবর্ণভূমি, তিব্বত, পূর্ব আসামের গিরিপথ বেয়ে মঙ্গোল শ্রেণিভুক্ত মানুষের বাংলায় আগমন ঘটে। .বাঙ্গালীর রক্তপ্রবাহে মঙ্গোলের মিশ্রণের প্রবাহ ক্ষীণ থাকলেও উত্তরবঙ্গের আত্মগোপনকারী আর্য ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে প্রথমে অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় রক্তের মিশ্রণ ঘটে এবং অনেক পরে মঙ্গোল রক্তের ধারার মিশ্রণ ঘটে। এই জাতি বর্তমান অবিভক্ত বঙ্গের বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের গর্বিত জাতি রাজবংশী। দীর্ঘকাল অনগ্রসরতার জন্য এই জাতিকে পশ্চাৎমুখীতা থেকে জোর্তিময় করার জন্য আত্মত্যাগব্রত নিয়েছিলেন রায়সাহেব পঞ্চানন।
আক্ষেপ এখানেই বঙ্গদেশের মনীষীদের অনুসন্ধানকালে তাঁকে দীর্ঘদিন সামনের সারিতে বসানো হয়নি। বহু আন্দোলন এবং রাজবংশী সমাজের শিক্ষার বর্তমান তুলনামূলক অগ্রসরতা হেতু তিনি বাঙ্গালীর চরিত্রাভিধানে আসন পেয়েছেন। তাঁর মণীষা সমস্ত ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়েছিল অবিভক্ত বঙ্গের রংপুর শহরকে ঘিরে। পশ্চিম বাংলার দক্ষিণ বঙ্গের কলকাতাসহ গোটা বাংলাদেশের তৎকালীন চিন্তাবিদদের প্রভাব রংপুর শহরে পড়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ সালে তাঁর ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে নিখিলেশকে বলেছেন- ‘চায়ের টেবিলে সন্দীপকে বললুম, তুমি রংপুর যাবে না? সেখান থেকে চিঠি পেয়েছি, তারা ভেবেছে, আমিই তোমাকে জোর করে ধরে রেখেছি।’ ঠিক এই উপন্যাসের তিন বছর আগে সারা বিশ্বে কবিগুরুর নোবেল প্রাপ্তি সংবাদ এবং অখন্ড উত্তরবঙ্গে পঞ্চাননের নেতৃত্বে উপবীত গ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্ষত্রিয়ত্ব প্রতিষ্ঠা একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের স্বদেশীয়ানার উদ্দীপনায় তাঁর জীবনে আর এক নতুন ঢেউ এলো। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, ব্রক্ষবান্ধব উপাধ্যায়ের সাথে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউয়ে সমকালীন যুবকদের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে সংগঠিত করার কাজটি সম্মন্ন করে ফেলেছিলেন তিনি।
১৯০১ থেকে ১৯৩৫ পর্য্ন্ত রংপুরের সঙ্গে তিনি সম্পূর্ণরূপে জড়িত। এই সময়কালে বঙ্গদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রত্যক্ষ করেছেন। শিক্ষা ও আর্থিক অনগ্রসর জাতিকে কিভাবে উন্নত থেকে উন্নততর করা যায়- এই ছিল তাঁর একমাত্র ব্রত। ইংরেজ সরকারের থেকে সমস্ত সুযোগ আদায় করার মূল লক্ষ্য ছিল রাজবংশী ক্ষত্রিয় জাতিকে মর্য্দাসম্পন্ন ও বলবান করা। উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূখন্ডকে শিক্ষা-সংস্কার ও আর্থিক দিক থেকে উন্নত করার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে যথেষ্ট সফলতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। ইংরেজ শাসনের সঙ্গে যুক্ত থেকে দেশের একটি বড় অংশের বৃহত্তর সমাজের অগ্রদূত ছিলেন।
স্বাধীনতা ফিরে পাবে এই আশ্বাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের জন্য বাঙ্গলা জাতীয় সেনাদল গঠন করলেন। জলপাইগুড়ি, রংপুর, দিনাজপুর ও আসামের ধুবরি প্রভূতি স্থান থেকে রাজবংশী যুবকরা সেনাদলে নাম লেখালেন। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের A nation in making গ্রন্থে এই বিষয়ে উল্লেখিত আছে।
জননেতা পঞ্চানন শিক্ষা বিস্তার ও আর্থিক বিস্তার ও আর্থিক উন্নয়নের উপর সবিশেষ গুরুত্ব দিলেন। এছাড়া জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পরা একটি সমাজের মানুষের মাঝে জাত্যাভিমান জাগ্রত করার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা। তাই শিক্ষা প্রসারে তাঁর বক্তব্য-‘বন্ধু সব! আপনাদের সকলের নিকট করজোড়ে শত শতবার বিনীতভাবে বলিতেছি, আপন আপন সন্তান সন্ততিদিগকে বিদ্যা-শিক্ষা করাইবেন। তাহাদের বিদ্যা শিক্ষার্থে যদি সর্বস্ব নিঃশেষিত হয়, যদি ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিয়াও ছেলে-পেলেকে লেখাপড়া শিখাইতে হয় তাহাও করাইবেন। তথাপি তাহাদের মূর্খ করিয়া রাখিবেন না।’ শিক্ষাই সকল উন্নয়নের প্রথম সোপান। এই চেতনাকে বৃদ্ধি করার জন্য শিক্ষা বিস্তারের জন্য গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ ছোট ছোট সভায় ধারাবাহিক বক্তব্য রাখতেন।
রায়সাহেবের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি গ্রামের মানুষের মধ্যে আদর্শরূপে গেঁধে রয়েছিল। বর্তমান পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে জন সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে সেখানেও সর্বাগ্রে শিক্ষাকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। তদানীন্তন অনুন্নত অখন্ড উত্তরবঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের জন্য আন্দোলন করে তিনি হয়েছেন এই অঞ্চলের ‘বিদ্যাসাগর’। বিদ্যাসাগরের মতোই তিনি সংস্কৃতে দক্ষ এবং ইংরেজিতে পারদর্শী ছিলেন। স্ত্রী-শিক্ষা প্রচারে এবং স্ত্রী-সম্মান রক্ষার্থে তাঁর দান বিদ্যাসাগরের চাইতে কম নয়। অথচ এই শিক্ষা আন্দোলনের জন্য করদমিত্র রাজ্য কুচবিহার-প্রশাসন থেকে সেরকম উৎসাহ বা উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়নি।
সেই সময় রংপুর ছিল সর্বাঙ্গীণভাবে রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমাজের প্রতীকী শহর। অন্যবর্গের জমিদারগনের রংপুরের ক্ষত্রিয় সমাজের জমিদাররাও ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সমাজ কল্যাণমুখী। এই বিষয়ে শ্যামপুরের খাজাঞ্চি, ডিমলার কামিনীকুমার সিংহ রায়, সদ্য পুষ্করিণীর প্রসন্ননাথ চৌধুরী, শিমূলবাড়ির হরিকিশোর বর্মা, প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যে প্রতিবাদী সামাজিক আন্দোলনের জন্য সমগ্র রাজবংশী সমাজ আন্দোলিত হয়েছিল তার হৃৎপিন্ড ছিলি এই রংপুর।
দিনাজপুরে পঞ্চানন বর্মার ক্ষত্রীয় আন্দোলন দেরীতে শুরু হলেও সেই জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ যথাক্রমে প্রেমহরি বর্মণ, শ্যামাপ্রসাদ বর্র্মণ, গোবিন্দচন্দ্র রায়, কবি নবদ্বীপচন্দ্র বর্মণ, বিশিষ্ট কমিউনিস্ট কর্মী ও বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য শ্রী রূপনারায়ণ রায় প্রমুখ রায় সাহেবের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজকে আন্দোলনের পথ এগিয়ে নিয়ে যান। ১৯২১ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্য্ন্ত রায় সাহেবের পঞ্চাননের তাঁর Political life ছিল অত্যন্ত active নিজের জাতিসত্তার বিকাশ ও উন্নয়ন করতে গেলে সমাজের অন্যান্য শ্রেণিরও বিকাশ প্রয়োজন, এই উপলব্ধি তাঁর বরাবর প্রখর ছিল।
১৯৯২ সালে বিধান পরিষদে চা-বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। বঙ্গীয় আবগারী আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেন। জেলা-মহকুমার ম্যাজিষ্ট্রেটদের আঞ্চলিক ভাষায় দক্ষতা আনার বিষয়ে প্রস্তাব করেন ১৯২৩ সালে। তৎকালীন সরকার প্রাথমিক শিক্ষার চাইতে মধ্যশিক্ষার গুরুত্ব দিতে চাইলে তিনি আপত্তি করে বলেন- “I beg to oppose all these motions, Primary education is a necessity of the day, but it seems more attention is paid by government to secondary Education than to primary education….. I say that primary education is an ablolute necessity.” সাধারণ মানুষ থানাতে নালিশ করতে যেতে ভীষণ ভয় পেতেন। এই বিষয়টিকে সহজ করার জন্য তিনি নানা উদাহরণ দিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিধান পরিষদে। বিধান পরিষদের সদস্যরূপে তাঁর অংশগ্রহণ তাঁকে মানবতাবাদী রাজনীতিবীদের উচ্চস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
পঞ্চানন বর্মা মৃত্যুকালে যে ব্যক্তিকে অত্যন্ত গুরু দায়িত্ব সহকারে ভারপ্রাপ্ত করে রেখেছিলেন, তিনি উপেন্দ্রনাথ বর্মণ। উত্তরবঙ্গের জন সমাজে উপেন্দ্রনাথের এই অন্বেষণের সোনালী ফসল হ’ল ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার জীবনচরিত, ক্ষত্রিয় জাতির ইতিহাস, প্রবাদ-প্রবচন ও হেঁয়ালী, জল্লেশ মহাপীঠ, উত্তরবাংলার সেকাল ও আমার জীবনস্মৃতি প্রভূতি। বহু সংবাদপত্রে, স্মারক পত্রিকায় সাময়িক পত্রে ও গ্রন্থে তাঁর মূল্যবান লেখা প্রকাশিত হয়েছে।”
গবেষক, লেখক, রাজনীতিবিদ যে কোনভাবেই তাঁর মূল্যায়ন করি না কেন সব ক্ষেত্রেই উপেনবাবুর উজ্জ্বল জ্যোতি অম্লান। মন্ত্রীসভায় তাঁর সততার কথা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দিনলিপিতে পাওয়া যায়। স্বীয়-শক্তির উপর গভীর আস্থা রেখে চারপাশের সমাজকে আত্মমর্যদায় স্বনির্ভ্রর করে তুলতে তিনি প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছিলেন।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ রংপুর শাখা পত্রিকা গ্রন্থাদি প্রকাশনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে পত্রিকা সমিতি গঠন করে। এই সমিতিতে থাকেন যথাক্রমে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ভবানী প্রসন্ন লাহিড়ী, সুরেশচন্দ্র রায়চৌধুরী, পঞ্চানন সরকার এবং হরগোপাল দাস কুন্ডু। এঁদের মধ্যে শ্রী পঞ্চানন সরকার (বর্মা) মহাশয়কে সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি সম্পাদক হয়েই তৎকালীন বৃহৎ উত্তরবঙ্গের লুপ্তপ্রায় সাহিত্য, লোকসংস্কৃতি ও দুষ্পাপ্য পুঁথির সম্পাদনায় মনোনিবেশ করেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৭ সালে তাঁর লোকসাহিত্য গ্রন্থ প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশের অবহেলিত গ্রাম সাহিত্যের প্রতি বিজ্ঞজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অনুরূপভাবে রায়সাহেব প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে প্রবাদ-প্রবচন (কথা ও ছিল্কা), রূপকথা ‘নাদিম পরামানিকের পাঁঠা’, জগন্নাথ বিলাই, মহিলা ব্রত’, ‘বাহা সে বা্ন্ধব’ ইত্যাদি পল্লীসাহিত্যকে নিভৃত অঞ্চল থেকে জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। কারণ এই সকল লোকসাহিত্যেই জীবনধারার পরস্পরকে খুঁজে পাওয়া যায়।
তিনি নিষ্ঠাবান গবেষকের মতো গোবিন্দ মিশ্রের গীতা আবিষ্কার করেন। দ্বিজলোচনের ‘চন্ডিকা বিজয়’ কাব্যকানি আবিষ্কার করে বিদগ্ধ মহলে বিষ্ময়ের সৃষ্টি করেন। ‘গোপীচন্দ্রের গান’ গ্রন্থে শব্দার্থ নিরূপণে সহায়তা করার জন্য গ্রন্থটির প্রথম সংস্ককরণের ভূমিকায় শ্রী বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য্ মহাশয় এই মনীষী পঞ্চাননের নিকট কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাপ রেখে গেছেন বিভিন্ন কবিতায়। ‘ডাংধরী মাও’, ‘বেটাছাওয়ার প্রতি’ কবিতাগুলি রচনা করে যুব সমাজকে সামাজিক আন্দোলনের অনুকূলে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। নানাবিধ স্বার্থক ভূমিকায় বাঙ্গালি চিন্তাবিদদের নক্ষত্র সভায় যেমন তিনি আলোকিত, তেমনি অন্যদেরকও উজ্জ্বল করেছিলেন আমাদের রায়সাহেব পঞ্চানন।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একজন সাবেক যুগ্মসচিব)। এছাড়াও তিনি বিশিষ্ট লোক সাহিত্য গবেষক এবং দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।
আমি চাই কেউ আমাকে ডাকুক
অচিন পাখির মতো শুভ্র সকালে
নিরলোভ আকুতি নিয়ে
চোখ রাখুক।
কেউ আমাকে ডাকুক অনাহুত
পাখির মতো অবিরাম!
বৃষ্টির শব্দ যেমন আনন্দ আলোক,
চাই কেউ আমাকে ডাকুক
মরমি মানুষের মতো মগ্ন দুপুর,
ছায়াঘেরা সবুজ
মায়াময় কেউ ডাকুক।
অনন্ত বসে আছি তাঁর জন্য
রাতের অন্ধকারে কুঁজো হয়ে।
দিনের খোঁজে নিঘুমরাত পার করে
কতবার খুজেছি তাঁকে!
আমি চাই পাখিটি ডাকুক
কোন এক পশর সকালে,
দরজার উঠোনে অচিন পাখি...
....... চৌধুরী নূরুল হুদা
হেফাজতের নায়েবে আমির আবদুল আউয়াল তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন উল্লেখ করে আল্লামা মামুনুল হক বলেছেন, ‘আমিরে হেফাজত আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী হুজুরের নির্দেশে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতিনিধিদল আবদুল আউয়াল হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে এখানে এসেছি। কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল, আমরা তা মীমাংসা করেছি। আমাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল আউয়াল হুজুর তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন।’
মাওলানা আবদুল আউয়ালের সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎ শেষে বের হয়ে বুধবার (৩১ মার্চ) বিকেলে একথা জানান হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক আল্লামা মামুনুল হক।
এসময় মামুনুল হক বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম কোনো প্রকার সহিংসতায় বিশ্বাসী নয়। আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছি, মহাসড়কে অবস্থান নিয়েছি। অনেক জায়গায় হেফাজতের দায়িত্বশীলদের রাজপথ থেকে উৎখাত করতে প্রশাসন উদ্যত হয়েছে। সেখান থেকে কোথাও কোথাও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তা হেফাজতের পক্ষ থেকে করা হয়নি।’
এসময় সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়ে মামুনুল হক বলেন, হেফাজতে ইসলাম সাংবাদিকদের সঙ্গে সব সময় ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় এবং তা অব্যাহত আছে। ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ ভুল বুঝে কোনো ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে, তবে তার সঙ্গে দায়িত্বশীলদের কোনো সম্পর্ক নেই।