আদালত অবমাননার দায়ে কুমিল্লার সাবেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) বিচারক সোহেল রানাকে এক মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই বিচারক বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কোনো বিচারককে কারাদণ্ড দেয়ার নজির এটিই প্রথম।
বৃহস্পতিবার বিচারপতি মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ও বিচারপতি মাসুদ হাসান দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। দণ্ডিত এই বিচারককে ৭ দিনের মধ্যে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন হাইকোর্ট।
বিচারক সোহেল রানার বিরুদ্ধে অভিযোগ, কুমিল্লার সিজেএম আদালতে বিচারক থাকা অবস্থায় হাইকোর্টের দেয়া স্থগিতাদেশ উপেক্ষা করে তিনি একটি মামলার অভিযোগ গঠনের আদেশ দিয়েছিলেন।
এছাড়াও একই মামলায় হাইকোর্টের আদেশ উপেক্ষা করে তিনি একাধিক আদেশ দেন। এরপর উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষার বিষয়ে ব্যাখ্যা দাখিল করেছিলেন সোহেল রানা। ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হয়ে সোহেল রানার প্রতি আদালত অবমাননার রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। রুলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট আজ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দিলেন। সূত্র: বিডি প্রতিদিন
ময়মনসিংহ ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩৭ হাজারের বেশি। প্রায় একই চিত্র শেরপুর ও যশোর ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালেরও। এ দুই আদালতে ১৮ হাজার ও ১২ হাজার মামলা সামলাচ্ছেন দুজন বিচারক। শুধু এ তিন আদালতই নয়, দেশের সব আদালতের বিচারকের কাঁধেই রয়েছে সক্ষমতার চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি মামলা। সম্প্রতি প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গড়ে বিচারকপ্রতি বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩০০-এর বেশি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ লাখে। এর মধ্যে অধস্তন আদালতগুলোয় ৩৭ লাখ ৩০ হাজার। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলা ছিল প্রায় ৬ লাখ। ২০১২ সালে বিচারাধীন মামলা ছিল ২১ লাখ ৩৫ হাজার। এক যুগের ব্যবধানে বিচার বিভাগে মামলার জট বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
আইনজ্ঞরা বলছেন, বিচারকস্বল্পতা ও এজলাস সংকট মামলাজটের বড় দুটি কারণ। পাশাপাশি আইনের ত্রুটি, সাক্ষী হাজির করতে না পারাও জট বৃদ্ধি করে। এসব সমস্যা দ্রুত দূর করতে পারলেই কমবে মামলাজট। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের দেশে বিচারকরা নিজেদের সক্ষমতার চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি মামলার চাপ সামলাচ্ছেন। সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডার অনুযায়ী, একজন বিচারকের কাছে সর্বোচ্চ ৫০০ মামলা থাকার কথা। এর চেয়ে বেশি মামলা থাকলেই ন্যায়বিচার না পাওয়ার শঙ্কা থাকবে। তাই যে কোনোভাবে বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।’
আইনজ্ঞরা আরও বলেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারপ্রার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কোনো কোনো মামলা নিষ্পত্তির জন্য তাদের যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বিচার বিলম্বের কারণে একদিকে মামলা পরিচালনার ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে ভোগান্তি। কোনো মামলায় সাক্ষী মারা যাচ্ছে, কোনো মামলায় বাদীও মারা যাচ্ছে। মামলাজটের সমস্যাটা বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও জট কমিয়ে আনার বিষয়ে সুপারিশ করে গত বছর আগস্টে আইন কমিশনও একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
মামলাজটের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকার মামলাজট কমানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তা কমানোর জন্য নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিছু কার্যকর পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। বিচারে গতি আনতে প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিচারক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এজলাস সংকট নিরসনে এরই মধ্যে সব জেলায় নতুন আদালত ভবন করা হয়েছে। আশা করছি, আমাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর সুফল খুব শিগগিরই পাওয়া যাবে।’
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালত পর্যন্ত সর্বত্র মামলাজট বেড়েই চলেছে। বিচারকের সংখ্যা বাড়িয়েও কোনো লাভ হয়নি। কারণ বিচারকের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মামলা দায়েরের সংখ্যা। ২০০৮ সালে আপিল বিভাগে বিচারপতি ছিলেন সাতজন। বিচারাধীন মামলা ছিল ৬ হাজার ৮৯২টি। এরপর আপিল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা আর কোনো দিন সাতের নিচে নামেনি। বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারপতি আটজন। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মামলা ছিল ২৬ হাজার ৫১৭টি। একইভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগেও ২০০৮ সালে বিচারাধীন মামলা ছিল ২ লাখ ৯৩ হাজার ৯০১টি। ওই সময়ে হাই কোর্টে বিচারপতি ছিলেন ৬৭ জন। ২০১০ সালের পর এ বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা কখনো ৯০-এর নিচে নামেনি। কিন্তু মামলাজট ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে হাই কোর্ট বিভাগে ৮৪ জন বিচারপতি দায়িত্বরত রয়েছেন। আর এ বিভাগে বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৪৭টি।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০০৭ সালের নভেম্বরে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের সময় অধস্তন আদালতগুলোয় বিচারক ছিলেন ৩০১ জন। বিপরীতে বিচারাধীন মামলা ছিল প্রায় ১৩ লাখ। বর্তমানে ২ হাজারের বেশি বিচারকের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৮০০ জন। আর অধস্তন আদালতগুলোয় বিচারাধীন মামলা ৩৭ লাখ ২৯ হাজার ২৩৫টি। এসব তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে একজন বিচারকের বিপরীতে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মামলা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক আদালতের পরিস্থিতি আরও খারাপ। কিছু কিছু আদালতে একজন বিচারকের আওতায় ৫ থেকে ১০ হাজারের বেশি মামলা রয়েছে। আবার একজন বিচারককে একাধিক আদালতেরও দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে বিচারকদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে মামলার চাপ সামাল দিতে। আর এ কারণে অনেক মামলার শুনানির তারিখ ধার্য হচ্ছে ছয় থেকে আট মাস পরপর। আবার অনেক সময় ধার্য তারিখে শুনানি না করেই তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এভাবেই বেড়ে যাচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, জনসংখ্যা অনুপাতে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিচারকের সংখ্যা কম। ১৭ কোটি ৩৮ লাখ জনসংখ্যার দেশে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন ১ হাজার ৮০০ বিচারক। অর্থাৎ গড়ে ৯৬ হাজার মানুষের বিপরীতে একজন বিচারক দায়িত্ব পালন করেন। যেখানে ভারতে আনুমানিক ৪৭ হাজার ৬১৯ জনের বিপরীতে একজন, পাকিস্তানে ৫০ হাজার, অস্ট্রেলিয়ায় ২৪ হাজার ৩০০, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার এবং যুক্তরাজ্যে প্রতি ৩ হাজার ১৮৬ নাগরিকের বিপরীতে একজন বিচারক দায়িত্ব পালন করেন।
গত ১ মার্চ এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘যে পরিমাণ বিচারক সারা বাংলাদেশে থাকা দরকার সে পরিমাণ বিচারক নেই। দেশে ৯০ থেকে ৯৫ হাজার মানুষের জন্য একজন বিচারক। এত কম বিচারক দিয়ে মামলাজট কমানো সম্ভব নয়। এ সংখ্যাটা বাড়াতে হবে। লজিস্টিক সাপোর্টসহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা বাড়াতে হবে।’
জট কমবে যেভাবে: মামলাজট নিরসনের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে নিজের বিচারিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মূলত দুটি কারণে মামলাজট বাড়ে। একটি হচ্ছে অবকাঠামো সমস্যা আর অন্যটি আইনগত জটিলতা।’ তিনি বলেন, ‘অবকাঠামোগত সমস্যার মধ্যে এজলাস ও বিচারক সংকট অন্যতম।’ বিচারক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে বছরে প্রায় ১০০ জন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তবে এ সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বিবেচনায় দু-তিন বছরের মধ্যে অন্তত ৫ হাজার বিচারক নিয়োগ দেওয়া জরুরি। আইন কমিশনও এমন সুপারিশই দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জট কমাতে হলে ছোটখাটো সমস্যাগুলো আদালতের বাইরেই সমাধান করতে হবে। ফৌজদারি আইনেও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলা আছে। একই সঙ্গে তদন্তের সময় কমানো, বিচারক ও সংশ্লিষ্টদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।’ এ ছাড়া নতুন কোনো থানা বা উপজেলা করা হলে ইউএনও, এসি ল্যান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানা বা উপজেলার জন্য একজন বিচারকের পদ সৃষ্টি করতে হবে বলেও মত দেন এই বিচারক।
মামলাজট নিরসনে আইনগত জটিলতা দূর করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিচারকাজে কিছু সময় ক্ষেপণের সুযোগ আমাদের আইনেই রয়েছে। এগুলো আগে দূর করতে হবে। যেমন নোটিস বা সমন জারিতে অনেক সময় চলে যায়। প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে নোটিস বা সমন জারি করা যেতে পারে। এতে সময় অনেকটা বাঁচবে। এ ছাড়া জবাব দাখিলে সময়সীমা নির্ধারণ করার পাশাপাশি বাদী বা বিবাদী পক্ষের বারবার সময় আবেদন নিরুৎসাহ করতে হবে।’ সাক্ষ্য আইন সংশোধন করে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার ও ভিডিও কনফারেন্সে সাক্ষ্য গ্রহণের বিধান যুক্ত করার প্রশংসাও করেন তিনি। এই বিচারক বলেন, ‘নতুন সাক্ষ্য আইন বিচারের সময় কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে। তবে এর যথাযথ অনুসরণ করতে হবে।’
আইন কমিশনের সুপারিশ: মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও জট কমিয়ে আনার বিষয়ে সুপারিশ করে গত বছর আগস্টে আইন কমিশন একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে জটের মূল পাঁচটি কারণ উল্লেখ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে: পর্যাপ্ত বিচারক না থাকা, বিশেষায়িত আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না হওয়া, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা, জনবলের অভাব এবং দুর্বল অবকাঠামো।
অন্য কারণগুলো হলো: মামলার সুষম বণ্টন না হওয়া, প্রশাসনিক শৈথিল্য, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না হওয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীর জবাবদিহির অভাব, আইনজীবীর আন্তরিকতার অভাব, দুর্বল মামলা ব্যবস্থাপনা, জমিজমা-সংক্রান্ত নথি সংরক্ষণের অভাব, প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যবহারিক জটিলতা, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, ক্রমাগত শুনানির অভাব, যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, নকল সরবরাহে অনিয়ম, উচ্চ আদালত কর্তৃক নথি তলব, সংশ্লিষ্ট মামলার আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিভিশন, মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ইত্যাদি।
মিথ্যা-হয়রানিমূলক মামলা কমাতে কয়েকটি সুপারিশও করে আইন কমিশন। এরমধ্যে আছে: মামলা দায়েরের সময় মিথ্যা, ফলহীন ও হয়রানিমূলক মামলা করার বিষয়টি নিরুৎসাহ করতে হবে। নালিশি মামলা গ্রহণের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর (ফরিয়াদি) অভিযোগ যাচাইয়ের মাধ্যমে মামলার রক্ষণীয়তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলা হলে বাদীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনের ২১১ ধারার আওতায় মামলা করার বাধ্যবাধকতা আনতে হবে এবং দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এতে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রবণতা কমবে এবং মামলার সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে পদ সৃষ্টি করে কমপক্ষে ৫ হাজার বিচারক নিয়োগ করা হলে জট কমিয়ে মামলার সংখ্যা সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে। তবে রাষ্ট্রের সীমিত সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্বল্প সময়ে এত বিচারক নিয়োগ করা সম্ভব নয়। আবার একসঙ্গে এত বিচারক নিয়োগ করলে তাদের গুণগত মানেরও অবনতি ঘটতে পারে। তবে ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫০০ বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে মত দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশে আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে মামলাজট নিরসনে কার্যকর ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে বিচারব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে। আইন কমিশন মনে করে, মামলাজট নিরসনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে এক বা একাধিক সমস্যা ও তার প্রতিকারের প্রতি নজর না দিয়ে সামগ্রিকভাবে গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। সূত্র: বিডি প্রতিদিন
লেখক: আরাফাত মুন্না, বাংলাদেশ প্রতিদিন
একদিন মদিনার দুই ব্যক্তি টেনে-হিচড়ে এক যুবককে অর্ধ পৃথিবীর শাসক খলিফা হজরত উমর রা.-এর দরবারে হাজির করল এবং বিচার দাখিল করল যে এই যুবক আমার পিতাকে হত্যা করেছে। আমরা এর ন্যায়বিচার চাই। তখন খলিফা হজরত উমর রা. ওই যুবককে প্রশ্ন করেন, তার বিপক্ষে করা দাবি সম্পর্কে। যুবকটি উত্তর দেন, তাদের দাবি সম্পূর্ণ সত্য। আমি ক্লান্তির কারণে বিশ্রামের জন্য এক খেজুর গাছের ছায়ায় বসেছিলাম। ক্লান্ত শরীরে অল্পতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার একমাত্র পছন্দের বাহন আমার উটটি পাশে নেই। খুঁজতে খুঁজতে কিছু দূর গেয়ে পেলাম, তবে তা ছিল মৃত। পাশেই ওদের বাবা ছিল। যে আমার ওই উটকে তাদের বাগানে প্রবেশে অপরাধে পাথর মেরে হত্যা করেছে। আমি রাগান্বিত হয়ে তাদের বাবার সাথে তর্কাতর্কি করতে করতে একপর্যায়ে তাদের বাবার মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করে ফেলি, ফলে সে সেখানেই মারা যায়। যা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটে গেছে। এর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
বাদি'রা বলেন, আমরা এর মৃত্যুদণ্ড চাই। হজরত উমর রা. সব শুনে বললেন, উট হত্যার বদলে একটা উট নিলেই হতো, কিন্তু তুমি বৃদ্ধকে হত্যা করেছ। হত্যার বদলে হত্যা, এখন তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তোমার কোনো শেষ ইচ্ছা থাকলে বলতে পারো। নওজোয়ান বলল, আমার কাছে কিছু ঋণ ও অন্যের কিছু আমানত আছে। আমাকে যদি কিছু দিন সময় দিতেন তবে আমি বাড়ি গিয়ে আমানত ও ঋণের বোঝা পরিশোধ করে আসতাম।
খলিফা হজরত উমর রা. বললেন, তোমাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না। যদি তোমার পক্ষ থেকে কাউকে জিম্মাদার রেখে যেতে পারো তবে তোমায় সাময়িক মুক্তি দিতে পারি।
নিরাশ হয়ে নওজোয়ান বলল, এখানে আমার কেউ নেই, যে আমার জিম্মাদার হবে। একথা শুনে হঠাৎ মজলিসে উপস্থিত আল্লাহর নবীর এক সাহাবী হজরত আবু জর গিফারি রা. দাঁড়িয়ে বললেন, আমি হবো ওর জামিনদার। সাহাবী হজরত আবু জর গিফারি রা.-এর এই উত্তরে সবাই হতবাক। একে তো অপরিচিত ব্যক্তি, তার ওপর হত্যার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি- কিভাবে তিনি এ লোকের জামিনদার হলেন!
খলিফা বললেন, আগামি শুক্রবার জুমা পর্যন্ত নওজোয়ানকে মুক্তি দেয়া হলো। জুমার আগে নওজোয়ান মদিনায়া না এলে নওজোয়ানের বদলে আবু জরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। মুক্তি পেয়ে নওজোয়ান ছুটল মাইলের পর মাইল দূরে তার বাড়ির দিকে। আবুজর রা. চলে গেলেন তার বাড়িতে। এদিকে দেখতে দেখতে জুমাবার এসে গেছে, নওজোয়ানের কোনো খবর নেই।
হজরত উমর রা. রাষ্ট্রীয় পত্রবাহক পাঠিয়ে দিলেন আবুজর গিফারি রা.-এর কাছে। পত্রে লিখা আজ শুক্রবার বাদ জুমা ওই যুবক যদি না আসে আইন মোতাবেক আবুজর গিফারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। আবুজর যেন সময়মতো জুমার প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে নববীতে হাজির হন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা মদিনায় থমথমে অবস্থার সৃষ্টি হয়। একজন নিষ্পাপ সাহাবী আবুজর গিফারী আজ বিনা দোষে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন! জুমার পর মদিনার সবাই মসজিদে নববীর সামনে হাজির। সবার চোখে পানি। জল্লাদ প্রস্তুত।
জীবনে কতজনের মৃত্যুদণ্ড দেখেছে- তার হিসাব নেই। কিন্তু আজ কিছুতেই চোখের পানি
আটকাতে পারছে না কেউ। আবুজরের মতো একজন সাহাবী সম্পূর্ণ বিনাদোষে আজ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন- এটা মদিনার কেউ মেনে নিতে পারছে না। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদানকারী খলিফা উমর রা.-ও অনবরত কাঁদছেন। তবু আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কারো পরিবর্তনের হাত নেই। আবু জর রা. তখনো নিশ্চিন্ত মনে হাসি মুখে দাড়িয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। জল্লাদ ধীর পায়ে আবু জর রা.-এর দিকে এগুচ্ছেন আর কাঁদছেন। আজ যেন জল্লাদের পা চলে না। পায়ে যেন কেউ পাথর বেঁধে রেখেছে।
এমন সময় এক সাহাবী জল্লাদকে বললো, হে জল্লাদ একটু থামো। মরুভুমির ধুলার ঝড় উঠিয়ে ওই দেখ কে যেন আসছে। হতে পারে ঐটা নওজোয়ানের ঘোড়ার ধূলি। একটু দেখে নাও, তারপর না হয় আবু জরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর কোরো। ঘোড়াটি কাছে এলে দেখা যায়-সত্যিই এটা ওই নওজোয়ানই। নওজোয়ান দ্রুত খলিফার সামনে এসে বলল, হুজুর বেয়াদবি মাফ করবেন। রাস্তায় যদি ঘোড়ার পা'য়ে ব্যথা না পেত, তবে সঠিক সময়েই আসতে পারতাম। বাড়িতে আমি একটুও দেরি করিনি। বাড়ি পৌঁছে গচ্ছিত আমানত ও ঋণ পরিশোধ করি এবং তারপর বাড়ি এসে বাবা-মা এবং নববধূর কাছে সব খুলে বলে চিরবিদায় নিয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। এখন আবু জর রা. ভাইকে ছেড়ে দিন, আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পবিত্র করুন। কেয়ামতে খুনি হিসেবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চাই না।
আশেপাশে সব নিরব থমথমে অবস্থা। সবাই হতবাক, কী হতে চলেছে। যুবকের পুনরায় ফিরে আসাটা অবাক করে দিলো সবাইকে। খলিফা হজরত উমর রা. বললেন, তুমি জানো তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে, তারপরে ও কেন ফিরে এলে? উত্তরে ওই যুবক বলেন, আমি ফিরে এসেছি, কেউ যাতে বলতে না পারে, এক মুসলমানের বিপদে আরেক মুসলামান সাহায্য করতে এগিয়ে এসে নিজেই বিপদে পড়ে গিয়েছিল।
এবার হজরত উমর রা. হযরত আবু জর গেফারী রা.-কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেন না চেনা সত্ত্বেও এমন লোকের জামিনদার হলেন। উত্তরে হজরত আবু জর গেফারী রা. বললেন, পরে কেউ যেন বলতে না পারে, এক মুসলমান বিপদে পড়েছিল, অথচ কেউ তাকে সাহায্য করতে আসেনি।
এসব কথা শুনে, হঠাৎ বৃদ্ধার দুই সন্তানের মাঝে একজন বলে উঠল, হে খলিফা, আপনি তাকে মুক্ত করে দিন। আমরা তার উপর করা দাবি তুলে নিলাম।
হজরত উমর রা. বললেন, কেন? তাদের মাঝে একজন বলে উঠল, কেউ যেন বলতে না পারে, এক মুসলমান অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল করে এবং নিজেই সেই ভুল শিকার করে ক্ষমা চাওয়ার পরও অন্য মুসলমান তাকে ক্ষমা করেনি।
সূত্র: নয়াদিগন্ত/ তথ্যসূত্র: হায়াতুস সাহাবা, পৃষ্ঠা: ৮৪৪
লেখক, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, মুফতী মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী-মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ ঢাকা