গত ২৪ ঘন্টায় করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ১৭৮ জন। এ নিয়ে করোনাভাইরাসে দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ২৩ হাজার ৯৮৮ জন।
এদিকে, গত ২৪ ঘন্টায় করোনাভাইরাসে শনাক্ত হয়েছে ৬,৮৮৫ জন। এ নিয়ে দেশে মোট করোনাভাইরাসে শনাক্তের সংখ্যা ১৪ লাখ ১২ হাজার ২১৮ জন।
আজ শনিবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে আরও জানানো হয়, গত ১ দিনে বাসা ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ৭৮০৫ জন করোনারোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ১২ লাখ ৮১ হাজার ৩২৭ জন।
উল্লেখ্য, বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ৩৩ হাজার ৩৩০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় প্রত্যেকটি মসজিদে অবশ্য পালনীয় ১০টি নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। আজ সোমবার হতে এই নির্দেশনা জারি করে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে সারাদেশে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৮ দফা এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৪ এপ্রিল বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কতিপয় দিক-নির্দেশনা দেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই ১০টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
১০ নির্দেশনা:
১. মসজিদের প্রবেশদ্বারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার/হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ সাবান-পানি রাখতে হবে এবং আগত মুসল্লিকে অবশ্যই মাস্ক পরে মসজিদে আসতে হবে।
২. প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসা থেকে ওজু করে, সুন্নত নামাজ ঘরে আদায় করে মসজিদে আসতে হবে এবং ওজু করার সময় কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
৩. মসজিদে কার্পেট বিছানো যাবে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে সম্পূর্ণ মসজিদ জীবানুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে, মুসল্লিদের নিজ নিজ দায়িত্বে জায়নামাজ নিয়ে আসতে হবে।
৪. কাতারে নামাজে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৫. শিশু, বয়োবৃদ্ধ, যেকোনো অসুস্থ ব্যক্তি এবং অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি জামায়াতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেন।
৬. সংক্রমণ রোধ নিশ্চিতে মসজিদের ওযুখানায় সাবান/হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। মসজিদে সংরক্ষিত জায়নামাজ ও টুপি ব্যবহার করা যাবে না।
৭. সর্বসাধারণের সুরক্ষা নিশ্চিতে, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীর নির্দেশনা অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
৮. মসজিদে ইফতার ও সেহরির আয়োজন করা যাবে না।
৯. করোনাভাইরাস মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নামাজ শেষে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে খতিব ও ইমামরা দোয়া করবেন।
১০. সম্মানিত খতিব, ইমাম এবং মসজিদ পরিচালনা কমিটি বিষয়গুলো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবেন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘এই নির্দেশনা লঙ্ঘিত হলে স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনী, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট মসজিদের পরিচালনা কমিটিকে উল্লিখিত নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার অনুরোধ জানানো হলো।’
লকডাউনের ঢাকায় তীব্র যানজট। মন্ত্রী আয়েশে কথা বলছেন মোবাইলে। সারা দিন সুনসান কক্ষে নিয়মনীতির জীবন থেকে একটু নস্টালজিক হতে চাইলেন মন্ত্রী। গাড়ির জানালাটা খুলে দিলেন। আচমকা ফোন নিয়ে দৌড় দিল এক দুষ্ট। মন্ত্রীর গাড়িতে ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী থাকেন। তিনি কী করলেন জাতি জানে না। ঘটনা ৩০ মের। এক সপ্তাহ পর মন্ত্রী নিজেই একনেকের বৈঠক শেষে জানালেন, এখনো তিনি তাঁর মোবাইল ফোন ফেরত পাননি। মন্ত্রীর মোবাইল অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বস্তু। মন্ত্রীর হাত থেকে মোবাইল ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়া তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এভাবে প্রকাশ্যে যদি মন্ত্রীর ফোন ছিনতাই হয় তাহলে তো মন্ত্রীও অরক্ষিত। ভাগ্যিস স্বয়ং মন্ত্রীকেই ছিনতাই করা হয়নি। এই মন্ত্রী অবশ্যই ভাগ্যবান। ১৯৭৩ সালে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর তিনি নানা পদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। যে সময় জাতির পিতার হত্যার বদলা নিতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। যখন জাতির পিতার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শিষ্য তোফায়েল আহমেদ সামরিক স্বৈরাচারের নির্মম নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে কারাপ্রকোষ্ঠে। আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে তাঁকে পিটিয়ে মুমূর্ষু করার সেই সময় এই মন্ত্রী অসাংবিধানিক সরকারের একান্ত অনুগত চাকুরে। তাঁর দীর্ঘ পেশাগত জীবনে তিনি জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং বেগম জিয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন নিপুণ দক্ষতায়। কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক, এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখার যুগ্মসচিবসহ নানা আকর্ষণীয় পদে তিনি তরতর করে উন্নতি করেছেন। ২০০৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ওই সময় একজন পাগলও জানত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ২০০১ সাল থেকে বিএনপি-জামায়াত যে দুঃশাসন চালিয়েছে, তা প্রতিরোধ করতে মানুষ মুখিয়ে। বাংলাদেশের আমলারা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দূরদর্শী চিন্তা করতে না পারলেও নিজেদের আয়-উন্নতির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সিদ্ধহস্ত। বারবার এটি প্রমাণিত।
এরশাদের আস্থাভাজন এবং বিশ্বস্ত আমলা প্রয়াত এম কে আনোয়ার ও কেরামত আলী যেমন বিএনপিতে যোগ দিয়ে নিজেদের অবসর-উত্তর জীবনের জন্য অসাধারণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। স্বৈরাচারের দোসর হয়েও তারা বিএনপির ‘গণতান্ত্রিক’ জমানায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হয়েছিলেন। তেমনি আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী হিসাবে পাকা। ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি হন। ২০১৪ সালে প্রতিমন্ত্রী। ২০১৯ সালে পূর্ণমন্ত্রী। আমলাতন্ত্রে পদোন্নতি প্রক্রিয়া তাঁর অবসর জীবনেও অব্যাহত থাকে। তাই তিনি সদা হাস্যময়, সর্বতো বিরাজমান। বাজেটের দিন বাজেট দিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু সব টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা গেল পরিকল্পনামন্ত্রীর সরব উপস্থিতি। ভাগ্যিস মন্ত্রীর সেদিন মোবাইলটাই ছিনতাই হয়েছিল। উনি নিজে যদি অপহৃত হতেন তাহলে বাজেট-পরবর্তী এত কথা কে বলতেন?
বাংলাদেশের আমলারা বিভিন্নকালে কিম্ভূত সব আবিষ্কার করেন। জিয়ার আমলে এক আমলা জিয়াকে খুশি করতে ‘জাতীয় পোশাক’ আবিষ্কার করেছিলেন। সচিবালয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের স্যুট-টাইয়ের বদলে জিয়ার পোশাকের আদলে সাফারি পরার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরশাদের আমলে আমলাদের বাড়বাড়ন্ত ছিল চোখে পড়ার মতো। বেগম জিয়ার আমলে একদা চৈনিক বাম আমলা বিভিন্ন সেক্টর করপোরেশনে বিশেষায়িত পদে আমলার অনুপ্রবেশ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। ২১ পর বছর আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায় ১৯৯৬ সালে। গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় বেগম জিয়ার। এক ভুতুড়ে নির্বাচনের মাধ্যমে কয়েক দিনের এক নৈশ সংসদে বেগম জিয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলটি পাস করে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। জনতার আন্দোলনের ফসল ঘরে তোলেন গুটিকয় আমলা। জনতার মঞ্চে এসেই তারা বাজিমাত করেন। এই দলের শিরোমণি আমলাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। দ্রুত তিনি আমলার পোশাক ছেড়ে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবিভর্‚ত হন। প্রতিমন্ত্রী হন। এই আমলা এখনো প্রবহমান নদীর মধ্যেই বহতা। তিনিও এক আবিষ্কারের জন্য অমর হয়ে থাকবেন। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা রানা প্লাজার পিলার ধরে টানাহেঁচড়া করেছিল। এজন্যই রানা প্লাজা নাকি ধসে পড়েছিল। আমলারা পারেনও বটে।
২০০১ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে আমলাদের ব্যাপক ক্ষমতায়ন হয়। এ সময় রাজনৈতিক কর্মীদের ভূমিকায় দেখা যায় আমলাদের। এ ধারা এখনো অব্যাহত। শুধু পার্থক্য হলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে চুল পরিমাণ সম্পর্ক থাকে, চৌদ্দগুষ্টিতে কেউ আওয়ামী লীগ করে এমন সবাইকে হয় চাকরি থেকে বিদায় অথবা নীলডাউন করার মতো ওএসডি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ এসব ব্যাপারে উদার। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি-জামায়াতপন্থি আমলারাও ঝটপট দ্রুত পদোন্নতি পান। আওয়ামীপন্থি আমলার আত্মীয়ও (বেয়াই) সচিব হন। আওয়ামীপন্থি আমলার বিশ্ববিদ্যালয়ের দোস্ত, তাই ছাত্রদল করেও কেউ সচিব হন।
আওয়ামী লীগ আমলে বরং ছাত্রলীগ করে সরকারি চাকরিতে এসেছেন এমন অনেকেই অবিচার এবং অবমূল্যায়নের শিকার হন। সে অন্য প্রসঙ্গ। আমি বলতে চাইছিলাম আমলাদের কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার ধারাবাহিকতা। সব সরকারের আমলেই আমলারা নিজেদের বলয়, প্রভাব এবং কর্তৃত্ব অব্যাহত রেখেছে। এখন তা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে আমলারা যেন গোটা সরকারকে গিলে ফেলেছে। এখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় নাকি আমলা লীগ ক্ষমতায় সে প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে যখন চারদিকে কথাবার্তা ঠিক তখন মন্ত্রিসভায় আমলাদের অন্যতম প্রতিনিধি বললেন, ‘আমলাতন্ত্র আমাদের মধ্যে আছে এবং থাকবে। ফেরাউনও আমলাতন্ত্রের বিকল্প বের করতে পারেনি।’ ৮ জুন একনেকের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমিও ছোটখাটো আমলা ছিলাম, এখন বড় আমলা।’
ফেরাউন নিকৃষ্ট স্বৈরাচার, জঘন্য, পাপিষ্ঠ একনায়ক। আল কোরআনে বিভিন্ন স্থানে ৬৭ বার ফেরাউন প্রসঙ্গ এসেছে। সুরা ইউনুসের ৮৩ নম্বর আয়াতে ফেরাউনকে ‘ন্যায় লঙ্ঘনকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফেরাউনের উদাহরণ মন্ত্রী কেন দিলেন? এটি অজ্ঞতা নাকি সুপ্ত ষড়যন্ত্রের অসতর্ক প্রকাশ? পৃথিবীর নিকৃষ্ট স্বৈরাচার কেন ‘আমলাতন্ত্র’ উৎখাত করবে? বাংলাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, যখনই অনির্বাচিত একনায়করা অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করেছে, তখন তারা আমলানির্ভর হয়েছে। আমলা বা সরকারি কর্মচারী, রাষ্ট্রের অনিবার্য অনুষঙ্গ। কেউ আমলাদের বিলোপ চায়নি। কিন্তু আমলাদের সর্বগ্রাসী রূপ গণতন্ত্র এবং জনঅধিকারের জন্য ক্ষতিকর, হুমকি। একটি দেশে গণতন্ত্র যত বেশি বিকশিত, আমলাতন্ত্র ততটাই নিয়ন্ত্রিত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলো একটি ভারসাম্যমূলক শাসনব্যবস্থা। এখানে ক্রিয়াশীল প্রত্যেকের নিজস্ব বৃত্ত থাকে। একে অন্যকে জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এর মাধ্যমেই গণতন্ত্রে জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটে। আমলারা যখন জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে যান, সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হন তখন তা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ান। বাংলাদেশে আমার মতো অনেকেই বিশ্বাস করেন, আমলারা ক্রমে তাদের গন্ডি অতিক্রম করেছেন। একটি রাজনৈতিক সরকার যখন আমলাদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে যায় তখন গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দুর্বল হয়ে যায়। এটিই আমাদের আশঙ্কার জায়গা।
ফেরাউনের মতো অত্যাচারী, ঘৃণিত, সীমা লঙ্ঘনকারীরা তো চাটুকার, স্তাবক আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হবেই। একটি জনগণের সরকার কখনো তা হবে না। যেমন হননি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আমলাদের জনগণের সেবক করতে চেয়েছিলেন। জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাসী জাতির পিতা ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আজ আমরা যারা এখানে আছি, তারা সরকারি বা বেসরকারি কর্মচারী। পুলিশ, সামরিক বাহিনী, বর্ডার গার্ড, রক্ষীবাহিনী বা আনসার যা-ই আমরা হই না কেন, সবাই এই বাংলাদেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই চলি এবং সবাইকে রাখা হয়েছে জনগণের সেবা করার জন্য।’ বঙ্গবন্ধু এটাই বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধু যা বিশ্বাস করবেন তা তিনি যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করে হলেও আদায় করতেন। আজকের এই বাংলাদেশ তার প্রমাণ। আমলাদের ‘জনগণের সেবক’ বানাতে চেয়েছিলেন জাতির পিতা। ফেরাউনের মতো ঘৃণিতরা আমলাতন্ত্রকে ক্ষমতাবান করে আর বঙ্গবন্ধুর মতো মহামানবরা আমলাতন্ত্রের ‘চেতনা’ পাল্টে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন।
বাকশাল যদি বাস্তবায়ন হতো তাহলে আমলারা আজকের মতো ফুলে ফেঁপে উঠতেন না। চতুর্থ সংশোধনী পাসের দিন জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে জাতির পিতা সে রূপরেখাও দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মেন্টালিটি চেঞ্জ করতে হবে। সরকারি কর্মচারী, মন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট- আমরা জনগণের সেবক, আমরা জনগণের মাস্টার নই।’ এজন্যই জেলা গভর্নরের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু রাজনীতিবিদদের দিয়েছিলেন, আমলাদের দেননি। জাতির পিতা যদি আর কিছুদিন দেশটা গোছাতে পারতেন, যদি তিনি তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করতে পারতেন তাহলে হয়তো মন্ত্রী এ রকম দম্ভভরে আমলাদের জয়গান করতে পারতেন না। তাহলে হয়তো আমলারা মাস্টার থাকতেন না, সেবকই হতেন। ’৭৫-এর পর আমলারা পরগাছার মতো রাষ্ট্রব্যবস্থায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। আমলাতন্ত্রকে কেউ অস্বীকার করে না। মৌর্য সাম্রাজ্যেও আমলাতন্ত্র ছিল। কিন্তু এ রকম একচ্ছত্র আমলানির্ভর ছিল?
ড. আকবর আলি খান ‘অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ শিরোনামে গ্রন্থে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র সম্পর্কে চমকপ্রদ কিছু কথা লিখেছেন। ‘বর্তমানে আইনত বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডারের সদস্যরা পাকিস্তানের সিএসপিদের চেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন।’ (পৃষ্ঠা : ২৪৬)। সরকারি আমলারা ক্ষমতাবান হচ্ছেন প্রতিদিন। এ নিয়ে কথাবার্তাও কম হচ্ছে না। তার পরও আমলারাই সবকিছু দখল করে নিচ্ছেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর নানাভাবে রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে না। এখন সরকারের শীর্ষ আমলাদের প্রায় সবাই চুক্তিতে। এখন চুক্তিভিত্তিক আমলাতন্ত্র চলছে দেশে। আর যারা চুক্তিতে থাকতে পারছেন না তাদের জন্য হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
বর্তমানে দেশের সব সাংবিধানিক এবং গুরুত্বপূর্ণ পদ আমলাদের দখলে চলে গেছে। নির্বাচন কমিশন থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন থেকে তথ্য অধিকার কমিশন- সর্বত্র আমলারা চেয়ার দখল করে রেখেছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানরা ঠুঁটো জগন্নাথ, ক্ষমতা সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হাতে। জেলার রাজা ডিসি। এখন আবার পৌরসভাও আমলাদের কর্তৃত্বে চলে যাচ্ছে। পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে।
মাননীয় মন্ত্রী বলবেন কি এমন সর্বগ্রাসী আমলাতন্ত্র বিশ্বে কোন দেশে আছে? আচ্ছা ধরে নিলাম আমাদের রাজনীতিবিদরা মূর্খ, লেখাপড়া জানেন না। এজন্যই চালকের আসনে আমলাদের বসানো হয়েছে, ভালো কথা। কিন্তু আমলারা জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে যান কীভাবে? আমলারা দুর্নীতি করলে তার বিচার করা যাবে না। আইন করে বিচার বন্ধ করা হয়েছে। আমলারা যৌন কেলেঙ্কারি করবেন, তাদের বিভাগীয় তদন্ত হবে। ফৌজদারি মামলা করা যাবে না। জামালপুরের এক ডিসির নারী কেলেঙ্কারি নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হলো। কিন্তু শাস্তি হলো পদাবনতি। কি আশ্চর্য! বাগেরহাটের আরেক জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির লিখিত অভিযোগের পর তাকে শুধু বদলি করা হলো। দুর্নীতি দমন কমিশনে যেতে হয় না দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত আমলাকে। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমলারা কি সবকিছুর ঊর্ধ্বে? ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর এ রকম আমলাতন্ত্রের পক্ষে সাফাই গেয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী ফেরাউনের উদাহরণ দেন, তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। অবশ্য ফোন হারিয়ে এত দিনে তা উদ্ধার করতে না পেরে মন্ত্রীর মানসিক ভারসাম্য ঠিক আছে কি না ভাবতেই হয়।
আমরা বরং মন্ত্রীর ফেরাউন-তত্ত্বকে আমলাদের যা খুশি তাই বক্তব্য হিসেবে উপেক্ষা করি। কিন্তু মন্ত্রীর ফোন উদ্ধারে আমরা একটি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতেই পারি। বাংলাদেশে সব সংকট সমাধানে আমলাতান্ত্রিক ফরমুলা অনুসরণ করা হয়। আসুন আমরা একটু কল্পনার জগতে যাই। মন্ত্রীর ফোন উদ্ধারে আমলারা কী করতে পারেন অনুমানের চেষ্টা করি।
মন্ত্রীর ফোন হারানোর ঘটনা তদন্তের জন্য একজন সচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চপদস্থ কমিটি গঠিত হলো। তদন্ত কমিটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হলো। তদন্তকাজের সুবিধার জন্য তদন্ত কমিটির সদস্যদের পৃথক পরিবহন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলো। তদন্ত কমিটি বাংলাদেশ মোবাইল ফোনের সংখ্যা কত তা জানার জন্য বিটিআরসিকে চিঠি দিল। বিটিআরসি এটি সব মোবাইল ফোন অপারেটরকে জানাল। এটি করতে করতে এক সপ্তাহ শেষ হলো। তদন্ত কমিটির মেয়াদ বাড়ানো হলো আরও সাত দিন। এবার তদন্ত কর্মকর্তারা আইফোন (যেহেতু মন্ত্রীর ফোনটি আইফোন) কার কার আছে সে তালিকা চাইলেন। এভাবে সপ্তাহ যায়, সময় বাড়ানো হয়, তদন্ত দ্রুত এগিয়ে যায়। তদন্ত দল বলল, তারা তদন্ত করছে, তদন্ত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
একপর্যায়ে তদন্ত দল গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য ‘অ্যাপেল’-এ সরেজমিনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আইফোন হারানোর তদন্ত হবে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপেলের অফিসে যাওয়া হবে না তা কী করে হয়! তদন্ত দল ছুটল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এভাবে এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর তদন্ত কমিটি ঘোষণা করল তারা তদন্ত শেষ করেছে। পাঁচ তারকা হোটেলে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ অনুষ্ঠান। ২ হাজার পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট। তদন্ত দলের প্রধান যিনি তদন্তের সময় সচিব ছিলেন, এখন সিনিয়র সচিব। অনেক কথা বললেন। শেষ কথা হলো এটাকে ছিনতাই বলা যায় না। কারণ মোবাইল ফোনটি ভয়ভীতি কিংবা অস্ত্র দেখিয়ে কেড়ে নেওয়া হয়নি।
যেহেতু এটি ‘ছিনতাই’ নয় চুরি তাই এটি এ কমিটির এখতিয়ারাধীন বিষয় নয়। কীভাবে চুরি হলো তা নিয়ে আরেকটি কমিটি হতে পারে। এ ছাড়া তদন্ত কমিটি ১০১টি সুপারিশ করল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মন্ত্রীরা গাড়িতে থাকা অবস্থায় জানালার কাচ নামাবেন না। মুঠোফোন মুঠোয় শক্ত করে ধরবেন। সিটবেল্ট পরবেন, ইত্যাদি।
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পর সাংবাদিকরা মন্ত্রীর কাছে ছুটলেন তাঁর প্রতিক্রিয়ার জন্য। মন্ত্রী বললেন ‘খুব ভালো রিপোর্ট, ইনডেপথ। তারা প্রচুর পরিশ্রম করেছেন।’ ভাগ্যিস ফেরাউনের আমলে মোবাইল ফোন ছিল না। ফেরাউনের যদি মোবাইল থাকত তাহলে মন্ত্রী অবধারিতভাবে বলতেন, ‘ফেরাউনেরও মোবাইল ছিনতাই হয়েছিল। ছিনতাই ছিল, আছে, থাকবে।’
লেখক: সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com /সংগৃহীত: বিডিপ্রতিদিন