বিশ্ব মানচিত্রের তিনটি দেশ এসে যে ইউনিয়নে মিলিত হয়েছে, এমন একটি ইউনিয়নের নাম ফারুয়া। পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলাধীন ফারুয়া ইউনিয়নের আয়তন ২৮০ বর্গ কিলোমিটার। দেশে এর চেয়ে কম আয়তনের অনেক উপজেলাও রয়েছে। আয়তনে বড় হলেও এই উপজেলায় লোকসংখ্যা বেশ কম।
প্রায় ১৮ হাজার নাগরিক অধ্যুষিত এই ইউনিয়নের মানুষ সভ্যতা থেকে এখনও অনেক দুরে। সড়ক যোগাযোগ নেই বললেই চলে, হাঁটাপথই এই উপজেলার মানুষের একমাত্র ভরসা। নেই বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক বা শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দিগন্ত বিস্তৃত বন বনানী আর পাহাড় সন্নিহিত জনপদ বিলাইছড়ি- যেন প্রকৃতির কোলে ঘুমিয়ে থাকা এক সবুজ রাণী।
বাংলাদেশ, মায়নমার ও ভারত; তিন দেশের সংযোগস্থল হলেও ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে উঠেনি কোনো কালেই। এই উপজেলা ঘিরে পর্যটন শিল্প বিকাশের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যোগাযোগ দুর্গমতা না কাটলে তা সুদুর পরাহত। এই উপজেলার ধুপপানি ঝর্ণার কলকল নাদ বেশ অনেক দুর থেকেই শোনা যায়। পায়ে হেটে যখন আপনি ঝর্ণার পাশে পৌঁছবেন; প্রকৃতির অপরূপ প্রতিচ্ছবি, আর মাটির শুধা গন্ধে নিমিশেই আপনার সমস্ত ক্লান্তি দুর হয়ে যাবে।
যে দিকে থাকাবেন শুধু উচু নিচু পাহাড় আর পাহাড়। স্থানীয়রা উৎপাদন করে প্রচুর পরিমানে নানা জাতের ফল ও শাক সবজি। কিন্তু এর কোনোটাই বাইরে বাজারজাতের সুযোগ নেই; সব খেয়ে নেয় চাষিরা নিজেরাই। এই তাজা সবজি, আর প্রকৃতির নির্মল বাতাসই স্থানীয়দের স্বাস্থ্য সতেজ রাখতে সাহায্য করে। কারণ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনোকালেই তেমন কোন চিকিৎসক থাকে না। র্বষা মৌসুমে সামান্য কিছু সবজি ও ফল বাইরে থেকে আসা পাইকারীরা সংগ্রহ করলেও তার ব্যবাসায়িক মূল্যায়ন উল্লেখ করার মতো নয়।
স্বাধীনতার বছরই এ ইউনিয়নের গড়ে উঠেছিল ফারুয়া বাজার। শনিবার দিন বসে সাপ্তাহিক হাট। তখন লোকে গিজ গিজ করে বাজারটি। নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের পসরা নিয়ে বাজারে বসে জুমিয়ারা। নানা রকম ফল, সবজি বিক্রি করে তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী কিনে নিয়ে যায়। অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেলেও এ বাজারের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। কালের বিবর্তনে বাজারের অনেকখানি বিলীন হয়ে গেছে রাইংখিয়ং নদীতে। একমাত্র মসজিদটিও ভাঙ্গনের কবলে রয়েছে দীর্ঘদিন।
২০১১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী লোকসংখ্যা ১৪ হাজার বলা হলেও বর্তমানে সেখানে অন্তত ১৮ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় যেমন পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তেমনি বিদ্যুৎ না থাকায় টেলিভিশন দেখারও সুবিধা নেই। সরকারের দেওয়া ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা থেকে অনকে দুরে এই ১৮ হাজার মানুষ। সোলারের সাহায্যে বর্তমানে কিছু এলাকায় টেলিভিশন দেখানো হচ্ছে।
স্থানীয় বাজার কমিটির সভাপতি হারুনুর রশিদ কিছু বলতে, তার মাঝে অপ্রাপ্তির দারুন হাহাকার। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এবিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নে নেই কোন মোবাইল নেটওয়ার্ক ও বিদুৎ। কাপ্তাই উপজেলা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও আজ অবহেলিত দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ পৌছায়নি। ফলে এবিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী দীপংকর তালুকদারের নিকট আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঠেগামুখ স্থলবন্দর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার লম্বা প্রস্তাবিত ট্রানজিট সড়কটির ভায়াপথ এই ফারুয়া। সড়কটির কাজ শুরু হলেও চলছে দ্রুত গতিতে। স্থানীয়দের দাবি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিটি গ্রাম শহর হতে দেরি হলেও আপাতত তারা যেন মোবাইল নেটওয়ার্ক, বিদ্যুৎ ও শিক্ষার সুযোগ টুকু পায়। আর সপ্তাহের হাটবারে শান্তিতে নিজের উৎপাদিত প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো কেনা বেচার সুযোগ পায়-এই অধিকারটুকু নিশ্চিত করা হোক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, ইতিপূর্বে বিএনপি’র আমলে এ পার্বত্য অঞ্চলে কোন প্রকার নেটওয়ার্ক এর আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির ৩ জেলায় প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় তিনিই মোবাইলের আওতায় এনেছেন। দুঃখের বিষয় দুর্গম কিছু এলাকায় যেমন ফারুয়া ইউনিয়নে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ এর আওতায় আনতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সংগঠনের চাঁদাবাজের কারনে উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
একুশে সংবাদ/ প.চ / এস
আপনার মতামত লিখুন :